হযরত উমর(রা.),এক মুসলিম কিংবদন্তী


আমীরুল মুমিনীন খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা:)
-----------------------------------------------------------------------
এই সেই শাসক যিনি বলেছিলেন, সুদূর ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুর ও যদি না খেয়ে মারা যায় তাহলে এই ওমর কে কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট জবাব দিতে হবে। যারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে বর্বর ও মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা বলে অপপ্রচার চালিয়ে থাকেন, তারা মানব সভ্যতার ইতিহাসে ওমরের (রা:) মত অন্য একজন শুধুমাত্র একজন শাসকের দৃষ্টান্ত পেশ করে দেখাক -

হযরত ওমর (রা:) তখন খলীফা। খলীফা ওমর (রা:) এর বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে একটি পানির কূপ। খলীফার সাক্ষাৎ প্রার্থী একজন লোক দেখলেন, খলীফা কূপ থেকে পানি তুলছেন। শুধু পানি তোলা নয় , আগন্তুক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, পৃথিবীর শাসক ওমর, পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য পদানতকারী ওমর (রা:) সেই পানি ভরা কলসি কাঁধে তুলে নিলেন। আগন্তুক আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি দ্রুত খলীফার নিকটে গেলেন। একজন অপরিচিত লোককে দেখে হযরত ওমর (রা:) বললেন, “ভাই, আপনার কি কোন কথা আছে, বলবেন আমাকে ?”

লোকটি বললেন, “হে আমিরূল মুমিনীন, যদি দয়া করে কলসটি আমার কাঁধে দিতেন।”

হযরত ওমর (রা:) যেতে যেতেই বললেন, “আমার ছেলে মেয়ের খাদ্য পানীয় সংগ্রহের মাধ্যমে পুণ্য সঞ্চয় করা কি আমার উচিত নয়? আচ্ছা, এছাড়া কি আপনি আর কিছু বলবেন ?”

আগন্তুক লোকটি বললেন, “আপনার এই অবস্থায় বলার মত কোন কথা আমার মনে আসছে না। আগে বাড়ি চলুন। তারপর বলব। আমি আপনাকে অপেক্ষা করতে বলব, আপনি কাঁধে বোঝা নিয়ে আমার কথা শুনবেন, এটা হতে পারে না”।

আগন্তুকের কথা শুনে ওমর (রা:) থমকে দাঁড়ালেন। বোধ হয় ভাবলেন, আমি আমার নিজের কাজ করছি, এ কাজের অজুহাতে আগন্তুককে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তিনি কাঁধ থেকে কলসি নামিয়ে জানুর উপর রাখলেন। তারপর বললেন, “বলুন, আপনার কথা।”

আগন্তুক ভীষণ বিব্রত বোধ করলেন, তার কথা শোনার জন্য আমিরুল মুমীনীন এভাবে কষ্ট করবেন। কলসি মাটিতে নামিয়ে রাখলে তবু কিছুটা কষ্টের লাঘব হয় তাঁর। তিনি খলীফাকে নিবেদন করলেন, “জানুর উপর কলস রেখে কথা শুনতে আপনার কষ্ট হবে। কলসটি দয়া করে মাটিতে নামিয়ে রাখুন।”

খলীফা বললেন, “তা কি করে হয় ভাই? কলসির তলা ভিজা। এ জমিটি আমার নয়, ভিজা কলসির তলায় লেগে অন্যের জমি আমার বাড়িতে চলে গেলে, আমি কি জওয়াবদিহি করব ?”

লোকটি বলল, “আমার জিজ্ঞাসার জবাব আমি পেয়ে গেছি, আপনি দয়া করে যান।”

ওমর (রা:) বললেন, “বুঝলাম না, বুঝিয়ে বলুন।”

লোকটি বলল, “ইয়া আমিরুল মুমিনীন, আমি জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম, বর্তমান জরীপে অন্যের জমির কতকাংশ আমার জমির সাথে উঠে এসেছে। তা আমার জন্য হালাল কিনা?"
-----------------------------------------------------------------------
"মদীনা"

ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী। খলীফা ওমর (রা:) লোকদের মধ্যে বায়তুল মালের কিছু অর্থ বন্টন করছেন। স্বাভাবিকভাবেই বিরাট ভীড় জমে গেছে। এ সময় সেখানে এলেন সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) তিনি প্রভাবশালী ও অভিজাত মায়ের সন্তান।

ভীড় দেখার পর অন্যান্যদের মত তাঁর ধৈর্য ধরার দরকার ছিল, কিন্তু তা তিনি করলেন না। তিনি ভীড় ঠেলে, দু'হাত দিয়ে লোকদের সামনে থেকে সরিয়ে ওমর (রা:)-এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন। ওমর (রা:) ব্যাপারটা আগেই লক্ষ্য করেছিলেন।

সুতরাং সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস(রা) তাঁর সামনে হাজির হতেই ওমর (রা:) তার হাতের দোররা কষলেন তার পিঠে। উপস্থিত সবাই দেখলো খলীফা একটা দোররা মেরেছেন সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) কে। দোররা মারার পর হযরত ওমর (রা:) সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) কে লক্ষ্য করে বললেন, "সবার এবং সবকিছুর উপরে যে আল্লাহর আইন, তা তোমার মনে নেই। আল্লাহর আইনের মোকাবিলায় তোমার কানাকড়িও যে মূল্য নেই, এটা তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।"

------------------------------------------------------------
"কাফির থেকে অশ্রুসিক্ত মুসলিম"

হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা:) নবী মুহাম্মাদ (সা:) এবং ইসলামের প্রতি তার মনোভাব এত কঠোর ছিল যে একদিন তিনি নবী (সা:) কে হত্যা করার জন্য বের হন। নবী (সা:) এর প্রচেষ্টা ও ইসলামের প্রসারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেই ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলতে চাইলেন। খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে গেলেন। পথে একজনের সাথে দেখা হলো, যিনি প্রথমে তাকে তার বোনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললেন। বিস্মিত হয়ে তিনি বোনের বাড়িতে গেলেন, দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে বোনকে ও বোনের স্বামীকে প্রহার করে রক্তাক্ত করলেন। তারপর তিনি থামলেন ও দেখলেন তিনি কি করেছেন। ঘরে প্রবেশের পূর্বে তিনি কুরআনের কিছু অংশ শুনেছিলেন এবং তা তার মনকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু তার ক্রোধ সেই ভাবকে অন্তের স্থায়ী হতে দেয়নি। যখন তিনি বোনকে আঘাত করলেন এবং রক্ত প্রবাহিত হল, তার চেতনা ফিরে এল। যা তিনি পূর্বে শুনেছিলেন তা তার অন্তরকে নাড়া দিল। তিনি সেটা আবার শুনতে চাইলেন এবং কুরআনের কিছু অংশ তাকে পড়ে শোনানো হলো। তিনি বদলে গেলেন। তার আমল পরিবর্তনের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। ইনিই সেই উমর।
আরেকবার, অন্য কোন সময়ে সাহাবারা তাকে দেখলেন তিনি বারবার হাসছেন, তারপর কাঁদছেন। তারা তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন : “আমার মনে পড়েছিল জাহেলী যুগে আমার একটি দেবতা ছিল খেজুরের তৈরি। একদিন আমি এত ক্ষুধার্ত হলাম যে তার একটি টুকরা খেয়ে ফেললাম। তারপর আমি কাঁদছিলাম আমার কন্যার কথা মনে করে যাকে আমি জ্যান্ত কবর দিয়েছিলাম। যখন আমি তাকে গর্তে নামিয়ে দিচ্ছিলাম, সে আমার দাড়িতে লেগে থাকা ধূলা ঝেড়ে দিচ্ছিল।” এবং তিনি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তখনকার রীতি—যারা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে তাকে হত্যা করতো। তার হৃদয় তখন কত কঠিন ছিল—কত কঠিন সেটা হতে পেরেছিল কন্যাটিকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার সময়। কিন্তু তার হৃদয় পরিবর্তিত হয়েছিল। এতখানি যে উমর যখন সালাতে ইমামতি করতেন, কান্নায় তার কন্ঠ এমনভাবে আটকে যেত যে এমনকি তৃতীয় সারি থেকেও লোকে তার কান্নার আওয়াজ শুনত। ইনিই ছিলেন উমর, এমন একজন যিনি এত কঠোর, এত শক্তিশালী, এত সাহসী ব্যক্তি… কিন্তু ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তার হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে গেল। তাই আমাদের উচিত নবী (সা:) এর উপদেশ মত আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তার কাছে কোমল হৃদয় চেয়ে দোয়া করা এবং নির্ভীক হৃদয় থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া।

মুসলিম ওমর থেকে খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা:)
-----------------------------------------------------------------------

"রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব‍্যাবহার"

মোমের আলোয় কাজ করছিলেন খলীফা ওমর (রা:)। এমন সময় সেখানে আসলেন তার দুই আত্মীয়। খলীফা তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন । অন্য আরেকটি মোমবাতি ধরিয়ে অতিথিদের বসতে দিয়ে তাদের খোজখবর নিলেন ।

কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন জানতে চাইলেন , আমাদের দেখে কেন আপনি আগের মোমবাতি নেভালেন আর নতুন একটি জ্বালালেন ? খলীফা জবাব দিলেন, আগের মোমবাতি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা। তোমরা যেহেতু আমার আত্মীয়, তাই তোমাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত অনেক আলাপ হবে। আমার নিজের কাজে জনগণের আমানত থেকে আমি কিছু খরচ করতে পারি না। তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই নিজের টাকায় কেনা মোমবাতিটি তোমাদের দেখে জ্বালালাম। এই জবাবে আত্মীয়রা হতভম্ব হলেন। তারা এসেছিলেন আত্মীয়তার খাতিরে বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়া যায় কি না , সেই অনুরোধ করতে। কিন্ত সামান্য মোমবাতি নিয়ে খলীফার এত বিবেচনা ও সতর্কতা দেখে নিজেদের প্রস্তাব জানাতে তারা আর সাহসই করলেন না ।

আরেকবার খলীফার কাছে এক লোক অবৈধ সুবিধা চায়। খলীফার সামনে রাখা কিছু কাঠে তখন আগুন জ্বলছিল। খলীফা বললেন, ঠিক আছে। তুমি এই আগুনের ভিতর তোমার হাত কিছু সময়ের জন্য রাখো, তারপর তোমার অনুরোধ আমি বিবেচনা করবো। লোকটি ভয় পেয়ে বললো, হে খলীফা এই আগুনে হাত ঢুকালে আমার হাত তো জ্বলে যাবে । খলীফা বললেন , তুমি দুনিয়ার এই সামান্য আগুনকে ভয় পাচ্ছ অথচ আমাকে তুমি দোযখের অনন্ত আগুনের ভিতরে নিয়ে যেতে চাও ? তদবিরকারী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে যায়।
-----------------------------------------------------------------------

"খলীফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা:) থেকে ওয়াদা রক্ষাকারী শাসক"

পারস্যের নিহাওয়ান্দ প্রদেশের শাসনকর্তা হরমুযান। পর পর অনেকগুলো যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বার পর এবং অগনিত মুসলমানকে নিজ হাতে হত্যা করার পর তিনি অবশেষে মুসলমানদের হাতে বন্ধী হলেন । হরমুযান ভাবলেন , খলীফা ওমর (রাঃ) নিশ্চয়ই তার প্রানদন্ডের হুকুম দেবেন, না হয় অন্তত তাকে গোলাম হিসাবে কোথাও বিক্রি করে দেবেন।

কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) বিশেষ কর দেওয়ার ওয়াদায় হরমুযানকে ছেড়ে দিলেন।

হরমুযান নিজ রাজ্যে ফিরে ওয়াদার কথা ভুলে গেলেন। অনেক টাকা-পয়সা ও বিরাট সৈন্য সমাবেশ নিয়ে তিনি আবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। অবশেষে হনমুযান পরাজিত হয়ে আবার মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেন। তাকে হযরত ওমর (রাঃ) এর দরবারে হাজির করা হলে খলীফা জিজ্ঞেস করলেন,
: আপনিই কি কুখ্যাত নিহাওয়ান্দ শাসনকর্তা হরমুযান?

: হ্যাঁ খলীফা , আমিই নিহাওয়ান্দ এর অধিপতি হরমুযান।

: আপনিই বার বার আরবের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছেন এবং বার বার অন্যায় যুদ্ধের কারন ঘটিয়েছেন?

: এ কথা সত্যি যে, আমি আপনার অধীনতা স্বীকার করতে রাজি হইনি, তাই বার বার যুদ্ধ করতে হয়েছে।

: কিন্তু এ কথা কি মিথ্যে যে, আপনাকে পরাজিত ও বন্দী করার পরও আপনার প্রস্তাবানুসারে সোলেহনামার শর্ত মতে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বার বার আপনি সোলেহনামার শর্ত ভংগ করেছেন এবং অন্যায় যুদ্ধে মুসলমানদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন?

: এ কথা মিথ্যা নয়।

: আপনি কি জানেন আপনার কি সাজা হবে?

: জানি, আমার সাজা মুত্যু এবং আমি সেজন্য প্রস্তত আছি।

: এবং এই মুহুর্তেই?

: তাও বেশ জানি।

: তা হলে আপনার যদি কোন শেষ বাসনা থাকে তা প্রকাশ করতে পারেন।

: খলীফা, মৃত্যুর আগে আমি শুধুই এক বাটি পানি খাব।

খলীফার হুকুমে বাটিতে পানি এল। হরমুযানের হাতে দেওয়া হলে খলীফা বললেন,

: আপনি সাধ মিটিয়ে পানি খেয়ে নিন।

: আমার শুধুই ভয় হয় পানি খাওয়ার সময়ই জল্লাদ না এক কোপে আমার মাথাটা দেহ থেকে আলাদা না করে দেয়।

: না হরমুযান, আপনার কোনই ভয় নেই। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই পানি খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপনাকে কতল করবে না ।

: খলীফা, আপনি বলেছেন এই পানি পান করা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আমায় কতল করবে না। ( বাটির পানি মাটিতে ফেলে দিয়ে) সত্যি এ পানি আর আমি খাচ্ছি না এবং তাই আপনার কথা মত কেউই আমাকে আর কতল করতে পারবে না।

চমৎকৃত হযরত ওমর (রাঃ) খানিক চুপ করে থেকে হেসে ফেললেন।

বললেন, হরমুযান: আপনি সত্যিই একটি নয়া উপায় বের করেছেন নিজেকে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু ওমরও যে আপনাকে কথা দিয়েছে তার খেলাপ হবে না। আপনি আজাদ, আপনি নির্ভয়ে নিজ রাজ্যে চলে যান।
হরমুযান চলে গেলেন। অল্পদিন পরে বহু সংখ্যক লোক নিয়ে আবার এলেন। খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন,
: আমিরুল মু'মিনিন! হরমুযান আবার এসেছে। এবার সে এসেছে বিদ্রোহীর বেশে নয়, এক নব জীবনের সন্ধানে। আপনি তাকে তার অনুচরবর্গসহ ইসলামে দীক্ষিত করুন।
হরমুযান আর বলতে পারলেন না। তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।
হযরত ওমর (রাঃ) দেখলেন, লৌহমানব হরমুযানের দু'চোখ পানিতে হলহল করছে । হরমুযানকে তিনি আলিংগন করলেন।

-----------------------------------------------------------------------
"ওমরের (রা:) ভাতা বৃদ্ধির চেষ্টা"

ওমর (রা:) এর খিলাফত। খলিফা হওয়ারা পূর্বে ওমর ব্যবসা করে পরিবার চালাতেন। যখন খলিফা নিযুক্ত হলেন, তখন জনসাধারণের ধনাগার (বাইতুলমাল) থেকে অতি সাধারণভাবে জীবন ধাণের উপযুক্ত অর্থ তাকে ও তার পরিবারের জন্য দেয়া হলো। বছরে মাত্র দু‘প্রস্থ পোশাক। পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের শক্তি যার কাকছে নত, সেই দোর্দন্ড প্রতাপ খলিফা ওমর সামান্য অর্থ পান জীবনধারণের জন্য।
হযরত আলী, উসমান ও তালহা (রা:) ঠিক করলেন খলীফার এ মাসোহারা যথোপযুক্ত নয়, আরও কিছু অর্থ বাড়িয়ে দেয়া হোক। কিন্তু কে এই প্রস্তাব খলীফা ওমরের কাছে পেশ করবে। অবশেষে ওমরের কন্যা ও রাসূলের (রা:) স্ত্রী হাফসাকে (রা:) তার কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। হাফসা (রা:) পিতার নিকট এই প্রস্তাব তুলতেই খলীফা ওমর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। রুক্ষস্বরে তিনি প্রশ্ন করলেন, “কারা এই প্রস্তাব করেছে?” হাফসা নিরুত্তর। পিতাকে তিনি কি উত্তর দেবেন? সাহস হলো না। খলিফা বললেন, “যদি জানতাম কারা এই প্রস্তাব তোমার মারফতে পাঠিয়েছে। তবে তাদের পিটিয়ে আমি নীল করে দিতনি। বেটি, তুমিতো জান, কি পোশাক রাসূল (সা:) পরিধান করতেন, কিরূপ খাদ্য তিনি গ্রহণ করতেন, কি শয্যায় তিনি শয়ন করতেন। বলত, আমার পোশাক, আমার খাদ্য, আমার শয্যা কি তার চাইতে নিকৃষ্ট?”
হাফসা উত্তর দিলেন, “না”। খলীফা বললেন, “তবে যারা এই প্রস্তাব করে পাঠিয়েছে, তাদের বলো, আমাদের নবী জীবনের যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তাতে থেকে আমি এক চুলও বিচ্যুত হবে না।”

সহজ অনাড়ম্বর ও নিঃস্বার্থ জীবন যাপন সত্যিকারক মানুষের আদর্শ-সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত যার জীবন নয়, সে কি করে শহীদের রক্তাক্ষরে লেখা সত্যের জীবনকে গ্রহণ করবে? খলিফা ওমরও এক দিন আততায়ীর হস্তে নিহত হন। সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে চলেছিলেন এই তার অপরাধ। খলিফা ওমর শহীদ হয়েছেন কবে, কিন্তু সত্যের নির্ভীক সাধক শহীদ ওমর আজও বেঁচে আছেন দেশ ও জাতির দিগদর্শরূপে।

-----------------------------------------------------------------------
"ওমর (রা:) ছেলের কান্না"
মক্তব থেকে এসে খলিফা ওমরের ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওমর (রা:) তাকে টেনে জিজ্ঞাসা করলেন, কাঁদছো কেন বৎস?
ছেলে উত্তর দিল, "সবাই আমাকে টিটকারী দেয়।" বলে, "দেখনা জামার ছেড়া, চৌদ্দ জায়গায় তালি। বাপ নাকি আবার মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা।" বলে ছেলেটি তার কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল।
ছেলে কথা শুনে বাইতুল মা'লের কোষাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেন, "আমাকে আগামী মাসের ভাতা থেকে চার দিরহাম ধার দেবেন। বাইতুল মা'লের কোষাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেন, "আমাকে আগামী মাসের ভাতা থেকে চার দিরহাম ধার দেবেন। ওমর (রা:) ভাবলেন কিছুক্ষন। তারপর বাইতুল মা'লের কোষাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেন, "আমাকে আগামী মাসের ভাতা থেকে চার দিরহাম ধার দেবেন।" উত্তরে কোষাধ্যক্ষ তাকে লিখে জানালেন, "আপনি ধার নিতে পারেন। কিন্তু কাল যদি আপনি মারা যান তাহলেকে আপনার ধার শোধবে?"
ওমর (রা:) ছেলের গা-মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, "যাও বাবা, যা আছে তা পরেই মক্তবে যাবে। আমাদের তো আর অনেক টাকা পয়সা নেই। আমি খলিফা সত্য, কিন্তু ধন সম্পদ তো সবই জনগণের।"
-----------------------------------------------------------------------
"মদীনার এক পল্লী, তখন রাত"

খলীফা ওমর (রা:) নাগরিকদের অবস্থা জানার জন্যে মদীনার রাস্তায় ঘুরছিলেন । হঠাৎ এক বাড়ীতে এক বৃদ্ধা ও তার কন্যার কথোপকথন শুনে দাঁড়ালেন । কান পাতলেন তিনি । বৃদ্ধা মেয়েকে বলছেন, "মা, দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করলে হয় না? তাহলে আমাদের অবস্থা আরও স্বচ্ছল হয়।"

কন্যা তার উত্তরে বললো, "তা কি করে হয়, মা । খলীফার হুকুম, কেউ দুধে পানি মেশাতে পারবে না।"

বৃদ্ধা বললো, "হোক না খলীফার আদেশ, কেউ তো আর দেখছে না।"

কন্যা প্রতিবাদ করে বললো, "না মা তা হয় না । প্রত্যেক বিশ্বাসী মুসলমানের কর্তব্য খলীফার আদেশ মেনে চলা । খলীফা না দেখতে পান কিন্তু আল্লাহ তো সর্বব্যাপী, তার চোখে ধুলো দেব কি করে?"

খলীফা ওমর (রা:) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলেন। এরপর তিনি বাড়ীতে ফিরে এলেন ।

তিনি ঘটনাটা ভুলতে পারলেন না । ভাবলেন, অজানা ঐ মেয়েটিকে কি পুরস্কার দেয়া যায় । অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন ।

পরদিন দরবারে এসে খলীফা সেই অজানা মেয়েটিকে ডাকলেন । আহুত হয়ে মা ও মেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ও কম্পিত পদে খলীফার দরবারে এসে উপস্থিত হলো ।

তারা উপস্থিত হলে খলীফা তাঁর পুত্রদের ডাকলেন । পুত্রদের নিকট গত রাতের সমস্ত বিবরণ দিয়ে তিনি তাদের আহ্বান করে বললেন, "কে রাজী হবে এই কন্যাকে গ্রহণ করতে? এর চেয়ে উপযুক্ত কন্যা আর আমি খুঁজে পাইনি।"

পুত্রদের একজন তৎক্ষণাৎ রাজী হলো । কন্যাও সম্মতি দিল । খলীফার ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল মেয়েটির।
-----------------------------------------------------------------------

"আমীরুল মুমিনীন কৈফিয়ত দিলেন"

শুক্রবার। জুমাআর নামায। ইমামের আসনে হযরত ওমর। খুতবার জন্য তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়েছেন। চারদিকে নিঃশব্দ নীরবতা। সকলের চোখ খলীফা ওমরের দিকে। হঠাৎ মসজিদের অভ্যন্তর থেকে একজন লোক উঠে দাঁড়াল। সে বলল, “উপস্থিত ভ্রাতৃগণ! গতকাল আমরা বাইতুল মাল থেকে এক টুকরা করে কাপড় পেয়েছি। কিন্তু খলীফা আজ যে নতুন জামাটি গায়ে দিয়েছেন, তা তৈরী করতে অন্ততঃ দুই টুকরা কাপড়ের প্রয়োজন। তিনি আমাদের খলীফা, এই জন্যই কি আরও টুকরা কাপড় বেশী নিয়েছেন?”
খলীফার পুত্র দাঁড়িয়ে বললেন, “আব্বাজানের পুরোনো জামাখানা গায়ে দেয়ার অযোগ্য হয়ে গেছে। এজন্য আমার অংশের টুকরাটি আব্বাজানকে দিয়েছি।”
 তাই দিয়েই জামা তৈরী হয়েছে।”
এই বার খলীফা সেই জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তিকে কৃত্রিম রোষে বললেন, “দেখুন সাহেব, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন?”
লোকটি বলল, “নিশ্চয় আমি বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসক আমীরুল মুমিনীন সম্বন্ধে অভিযোগ করেছি।”
খলীফা পুনরায় বললেন, “আচ্ছা সত্যই যদি আমি এমন কাজ করতাম, আপনি কি করতেন।?”
খলীফার কথা শেষ হবার সংগে সংগেই লোকটি সজোরে বলল, “তরবারি দিয়ে আপনার মস্তক দুইখন্ড করে ফেলতাম।”
লোকটির এ ধৃষ্টতা দর্শনে জামাতের সকলেরই মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। কিন্তু খলীফা হাত উঠিয়ে হাসি ও খুশী ভরা গদগদ কণ্ঠে মোনাজাত করলেন, “ইয়া আল্লাহ, আপনার শুকরিয়া যে, আপনার প্রিয় নবীর বিধান রক্ষার্থে নামাযের জামাতে বসেও এমন বিশ্ব ভীতি ওমরকে তলোয়ার দেখাবার মুসলমানের অভাব নেই।”
-----------------------------------------------------------------------
শুক্রবার। জুমআর নামায পড়তে খলীফা মসজিদে গেছেন। সামনে পিছনে তালি দেয়া একটি কামিছ তার গায়ে। একজন অনুযোগ করে বলল, “ আল্লাহ আপনাকে প্রচুর দিয়েছেন, আপনি অন্ততঃ একটু ভালভাবে পোষাক পরিধান করুন।” খলীফা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, “প্রাচুর্যের মধ্যে সংযম পালন ও শক্তিমানের পক্ষে ক্ষমা প্রদর্শন অতীব প্রশংসনীয়।” উৎসর্গীকৃত জীবন যাদের, আড়ম্বর- বিলাস, সুখাদ্য গ্রহণ, পোশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য দেয়ার সময় তাদের কোথায়?

-----------------------------------------------------------------------
"বড় ওমরের ছোট অতীতকে স্মরণ করা"

"এমন একটা সময় ছিল আমার জীবনে, যখন আমি খালাম্মার ছাগল চরাতাম। পরিবর্তে তিনি আমাকে দিতেন মুষ্টিতে করে খেজুর। আর আজ সেই আমি এই অবস্থায় উপনীত হয়েছি।" একদিন মসজিদের মিম্বরে উঠে হযরত ওমর (রা:) শুধু একথা কয়টি বলেই নেমে পড়লেন।

ঐ কথাগুলো এবং এই ধরণের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সবাই অবাক হলেন। আবদুর রহমান ইবন আউফ (রা:) বলেই ফেললেন, "আমীরুল মুমিনীন, এর দ্বারা তো আপনি লোকদের সামনে নিজেকে ছোট করলেন"।

হযরত ওমর (রা:) বললেন, "ঘটনা হলো, একাকীত্বের সময় আমার মনে একথা জেগেছিল যে, তুমি আমীরুল মুমিনীন, তোমার চেয়ে বড় কে হতে পারে। তাই আমি প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে দিলাম যেন ভবিষ্যতে এমন কথা মনে আর না না জাগে।"

শুধুমাত্র মুসলমান হলে হবে না, আবু বক্কর (রা:) আর ওমর (রা:) গল্প শুনলেই হবে না। মনের ভিতর ললন ও পালন করতে হবে, আসুন জীবনটাকে ইসলামের আদর্শে গড়ি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ