শুনতে কি পাও?



একটা রাস্তার কথা কল্পনা করা যাক।রাস্তাটা একেবারেই ঋজু। রাস্তার দুইপাশে দুইটি দেয়াল। আর সে দেয়ালে রয়েছে বেশ কয়টি দরজা। দরজাগুলো খোলা, তবে সেগুলোকে ঢেকে রেখেছে পাতলা পর্দা। রাস্তার প্রবেশপথে একজন আহ্বানকারী রয়েছেন। যিনি বলছেন, “ওহে মানুষেরা! সবাই এই রাস্তা দিয়ে চলতে থাকো। এ রাস্তা ছেড়ো না (অর্থাৎ, রাস্তার পাশে যে দরজা আছে তাতে প্রবেশ করো না)।
আরেকজন আহ্বানকারী রয়েছেন যিনি ভেতরে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। যখনই কেউ কোনো দরজার পর্দা সরাতে চায় সে ধমক দিয়ে বলে, “ধিক তোমাকে! এই পর্দা সরিয়ে ফেলো না। কারণ, পর্দা সরালেই তুমি দরজার ভেতরে ঢুকে পড়বে।”

ঠিক এমন একটা রাস্তার কথা আল্লাহ তা’আলা রূপক হিসেবে বর্ণনা করেছেন রাসূল (সা)- এর একটি হাদিসে। রাসূল (সা) এরপর বুঝিয়ে দিয়েছেন এ রূপক হাদিসটি দিয়ে কী বুঝানো হয়েছে। তিনি বলেছেন,

“সহজ-সরল রাস্তাটি হচ্ছে ইসলাম।
রাস্তার দুইপাশে দুইটি দেয়াল হচ্ছে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা।
আর দরজাগুলো হচ্ছে গুনাহের দরজা (এ দরজা দিয়েই মানুষ পাপে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা লঙ্ঘন করে)।
যিনি রাস্তার প্রবেশপথে আছেন, তিনি হচ্ছেন কুরআন।
আর ভেতরে রাস্তার ওপর যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক বা নিদর্শন যা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে রয়েছে।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নংঃ ১৭৬৩৪। আলবানী (রহ)-এর মতে সহীহ, মিশকাতুল মাসাবিহ, ১/৬৭)

কেউ যদি এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাহলে তার পরিণাম কী হয়? মূলত তাদের পরিণতি দুইরকমের হয়। ইবনে রজব (রহ) এদের ব্যাপারে লিখেছেন,
“নিজের নাফসের কারণে হোক অথবা বিভ্রান্তিতে পড়ে হোক, দুনিয়াতে যারা এই সরল পথকে ছেড়ে দেয়ালের ডানে ও বামে থাকা হারাম দরজা দিয়ে প্রবেশ করে, (১) তাদের মধ্যে কেউ কেউ ডানে ও বামে থাকা দরজাগুলোর হুকে আঁটকে যায়। কারো দেহ হুকের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কিন্তু তারপরেও সে কোনোমত বেঁচে যায়। আর (২) তাদের কেউ কেউ একদম জাহান্নামে গিয়ে পতিত হয়।” (মাজমু রাসাইল, ১/২০৬)

এখন এই হাদিসটা কিছুক্ষণ চিন্তা করতে করতে ইউসুফ (আ)-এর ঘটনাটিতে ঘুরে আসা যাক। আযীযের স্ত্রী যখন ইউসুফ (আ)-কে অশ্লীল কাজের দিকে আহ্বান করেছিলেন, আল্লাহ তা’আলা সে ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-
“সেই রমণীতো তার প্রতি আসক্ত হয়েই ছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত যদি না সে তার রবের নিদর্শন (বুরহান) প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এভাবে আমি নিদর্শন দেখিয়েছিলাম।" (সূরা ইউসুফ ১২:২৪)

এখানে আল্লাহ তা’আলা নিদর্শন বা বুরহান বলতে কী বুঝিয়েছেন তা নিয়ে মুফাসসিরদের মতভেদ রয়েছে।

কেউ কেউ বলেছেন, এ বুরহান ছিল, আল্লাহ তা’আলা সে নির্জন ঘরে ইউসুফ (আ)-এর পিতা ইয়াকুব (আ)-এর ছবি তাঁর সামনে এনে দেন। ইয়াকুব (আ) আঙ্গুল কামড়াচ্ছিলেন আর তাঁকে গুনাহটি করতে নিষেধ করছিলেন।
 আবার অন্যরা বলেছেন, এ বুরহান ছিল কুরআনের একটি আয়াত। ইউসুফ (আ) যখন ঘরের ছাদের দিকে তাকান তখন সেখানে কুরআনের একটি আয়াত দেখতে পেলেন- "আর ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেয়ো না। এটা খুবই অশ্লীল কাজ আর মন্দ পথ।” (সূরা ইসরা ১৭:৩২)

আবার কেউ কেউ বলেছেন, সে ঘরে একটা মূর্তি ছিল। মহিলা সে মূর্তির পূজা করত। গুনাহ করার আগে মহিলা লজ্জাবশত মূর্তিটা ঢেকে দিচ্ছিলো। তখন ইউসুফ (আ) ভাবলেন, আমার রব তো আরো বেশি লজ্জা করার যোগ্যতাসম্পন্ন। তাঁর দৃষ্টিকে কোনো পর্দা ঠেকাতে পারে না। [তাফসীরে জালালাইন (বাংলা), ৩/২৩৯]

আসলে সে বুরহান কী ছিলো সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রয়েছে আল্লাহর কাছেই। তবে এর স্বরূপ নিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ) বেশ সুন্দর মতামত দিয়েছেন। তার মতে, এ বুরহান বা নিদর্শন ছিল সেই আওয়াজ যা প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরে পাওয়া যায়। একটু আগে যে আহ্বানকারীর কথা বললাম তার কথা মনে আছে? যে সবাইকে দরজার মধ্যে দিয়ে ঢুকতে নিষেধ করছিলো? 

ইবনে তাইমিয়া (রহ)-এর মতে, এ কণ্ঠস্বর-ই ইউসুফ (আ)-কে সে গুনাহ থেকে বাঁচিয়েছিলো। আর সব মুসলিমকেই এমন গুনাহ থেকে রক্ষা করবে যদি তারা সে বুরহানকে গুরুত্ব দিয়ে শোনে।

এই কণ্ঠস্বর সব মুসলিম-ই কম বেশি শুনেছে। অন্তর থেকে আসা এই আওয়াজ-ই আমাদেরকে কোনো গুনাহ করতে যাওয়ার সময় বলে-
- আল্লাহকে ভয় করো। কী করছ তুমি এটা?
- এটা যে করছ, তোমার কী খারাপ লাগছে না?
- কিয়ামতের দিন এসব গুনাহ নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে কী করে?

দুনিয়ার সবার আওয়াজকে ফাঁকি দিলেও এ বুরহানকে ফাঁকি দেয়া যায় না। এক আরব কবি তাই বলেছেন-

وإذا خلوت بريبة في ظلمة *** والنفس داعية إلى الطغيانِ
فاستحيي من نظر الإله وقل لها *** إن الذي خلق الظلام يراني

“যদি থাকো তুমি একা কোনো এক অন্ধকার ঘরে,
আর তোমার নাফস তোমায় বলে পাপে লিপ্ত হতে।
তখন লজ্জিত হও রবের দৃষ্টির কথা ভেবে, আর বলো নিজেকে নিজেই,
যিনি এই আঁধার সৃষ্টি করছেন, তিনি তো দেখছেন আমাকেই।”

শেষ কবে এই কণ্ঠস্বর শুনেছেন আপনি?
- সেটা কি ফজরের সময় এলার্ম বন্ধ করে দেয়ার সময়? কেউ কি তখন আপনাকে বলেছে, “এখন এলার্ম বন্ধ করলে আর সালাত পড়তে পারবে না। ফরয সালাত কাযা হয়ে যাবে।”
- নাকি অনলাইনে খারাপ ওয়েবসাইটে ক্লিক করার সময় অন্তরের ভেতর থেকে আসা সেই কণ্ঠস্বর আপনাকে বলেছে, “সামান্য একটু আনন্দের জন্যে এটা কী করছ? একটু পর যখন নিজেকে জাহান্নামের কীট মনে হবে তখন কেমন লাগবে? আল্লাহকে ভয় করে প্লীজ এটা করো না।”

নাকি বারবার একই গুনাহ করতে করতে সে কণ্ঠস্বরকে আপনি গলা টিপে মেরে ফেলছেন? এখন আর সেই আওয়াজ আপনি শুনতে পান না। এখন তাই আপনার আর গুনাহ করতে খারাপ লাগে না। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন-

“শেষ কবে শুনেছি সেই কণ্ঠস্বর?”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ